মেলিন্ডা

মেলিন্ডা
প্রচণ্ড মাথাব্যথা। ঘুম আসছে না তবু। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক চোখ বুজে শুয়ে। এলোমেলো চিন্তা মাথায়। এরমধ্যে রাত-দুপুরে ফেসবুক খুলে বিল এবং মেলিন্ডাকে নিয়ে একটা লেখা দেখার পর সত্যি সত্যি খুব কষ্ট লাগল।
৩৫ বিলিয়ন ডলারের মালিকানা আসার একটা পোস্ট ঘুরছে ফেসবুকে। নানাজন নানাভাবে এ নিয়ে লিখছেন। কিন্তু লেখাগুলোর কোথাও তেমন নেই একটা ব্যাপার - মেলিন্ডা একজন মানুষ, বিলের স্ত্রী হওয়া ছাড়াও তাঁর একটা আলাদা অস্তিত্ব আছে। এ নিয়ে কোনো পোস্ট দিইনি, কোনো কমেন্ট করিনি। আজ, প্রচণ্ড মাথাব্যথা নিয়েও মনে হচ্ছে, একটু লিখি।
মেলিন্ডার বয়স এখন ৫৬। আর কতদিন বাঁঁচবেন? ৩০-৪০ বছর বড়জোর? বা আরেকটু বেশি। ৩৫ বিলিয়ন ডলার তো তিনি কোঁৎ করে গিলে ফেলবেন না। কবরেও নিয়ে যাবেন না। কী করবেন এত টাকা দিয়ে? আমি জানি না। আন্দাজ করতে পারি, এর বেশ খানিকটা তিনি দান করে দিবেন। কিছুটা তাঁর সন্তানরা পাবেন। কিন্তু এই আন্দাজ নিয়ে কথা বললে কেউ মানবে কেন? তারচেয়ে বরং মেলিন্ডার গল্প বলি একটুখানি।
মেলিন্ডা সেন্ট মনিকা ক্যাথোলিক স্কুলের টপার। ১৪ বছর বয়সে অ্যাপল-২ দিয়ে কম্পিউটারের সঙ্গে পরিচয়। ১৯৮৬ সালে ডিউক ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্স এবং ইকোনোমিকসে অনার্স করেছেন! তাঁরপর করেছেন এমবিএ। গ্রাজুয়েশনের পর মাইক্রোসফটে মার্কেটিং ম্যানেজারের কাজ নিয়েছেন। তাঁর হাত দিয়ে (একার না অবশ্যই) বেরিয়েছে এনকার্টা, পাবলিশার, ওয়ার্ডের মতো সফটওয়্যার। ১৯৯৬ পর্যন্ত কাজ করেছেন মাইক্রোসফটে। তারপর কী করেছেন, জানেন? পরিবার শুরু করার জন্য সব কাজ ছেড়ে দিয়েছেন, মাইক্রোসফটের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। এই লাইনটা খুব, খুব ভালো করে পড়ুন। মাথায় গেঁথে নিন।
একটু মনে করে দেখুন তো, পরিবার শুরু করার জন্য বিল কি মাইক্রোসফটের কাজ ছেড়ে দিয়েছেন? ভাবুন। তাঁদের ৩ সন্তান কি হাওয়া খেয়ে বড় হয়ে গেছে? ভেবে দেখুন একটু।
মেলিন্ডা কিন্তু কাজ থামাননি। নিজের পরিবারের পাশাপাশি মানুষের সেবায় কাজ করেছেন। ২০০০ সালে বিলের সঙ্গে সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গড়েছেন বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন। ২০১৩ সালে যখন তাঁদের ফাউন্ডেশনের এনুয়াল লেটার লেখা হয়, বিলকে তিনি বলেন, একসঙ্গে লিখবেন। বিল তাঁকে সেই লেটারের সহলেখক হতে দেননি। বাধ্য করেছেন আলাদা করে লিখতে। এনুয়াল লেটারে সাধারণত কোম্পানি পরের বছর কী কী প্রজেক্ট করবে বা কোন প্রজেক্টগুলো চালিয়ে যাবে, ইত্যাদি নিয়ে লেখা হয়। বিল নিজে কোম্পানির মূল এনুয়াল লেটার লিখেছেন। মেলিন্ডা আলাদা লেটারে লিখেছেন কন্ট্রাসেপটিভ নিয়ে। কী হতো না লিখলে? কিছু মানুষের ক্ষতি হতো। মেলিন্ডার কী ক্ষতিটা হতো, বলুন তো? ২০১৫ সালে এসে বিল মেলিন্ডাকে এনুয়াল লেটারের সহলেখক হতে দিয়েছেন। একসঙ্গে স্বাক্ষর করেছেন লেটারে। ব্যাপারটা ছিল সম্মানের, নিজেকে সমান হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার। মেলিন্ডা তা করে দেখিয়েছেন আবারও।
এবারে আমাদের পরিবারের গল্প বলি আপনাদের। আমার মা অনার্স গ্রাজুয়েট, বাবাও। বাবা ছিলেন পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের চাকরিজীবী, মা সরকারি চাকরি করতেন, শিক্ষকতা। বড় ভাইয়ের জন্মের পর আমার মা চাকরি ছেড়ে দেন। তারপর গত এতগুলো বছর ধরে টানছেন সংসার।
আপনার মায়ের কথা ভাবুন। আপনার বন্ধুদের, পরিচিতদের মায়ের কথা ভাবুন। এবারে বলুন তো, আপনার বাবা যে সম্পদ আয় করেছেন, যত বাড়ি-গাড়ি-জমি-জমা - এসবে আপনার মায়ের অর্ধেকটা অধিকার কি নেই? আল্লাহ না করুক, কোনো কারণে তাঁদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে আপনি কি চাইবেন আপনার মা সম্পদের ভাগ নেবেন না? নাকি নিলে মনে করবেন, এই সম্পদের জন্যই তিনি ছেড়ে যাচ্ছেন আপনার বাবাকে?
মেলিন্ডা, নিজের ক্লাসের টপার, ডাবল মেজর নিয়ে অনার্স করা মানুষটা, নিজ যোগ্যতায় যিনি মাইক্রোসফটকে অনেকদূর টেনেছেন, ১৯৯৬ সালের পর পরিবারের জন্য সব ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেই মানুষটা যখন আজ, এত বছর পরে এসে, পারষ্পরিক সমঝোতার বিচ্ছেদের জন্য আপনার কাছে 'অর্থলোভী' ট্যাগ পান, আপনাদের জন্য আমার দুঃখ হয় না, আপনার মা-বোন-স্ত্রীর জন্য আমার প্রচণ্ড কষ্ট লাগে।
চিন্তা করুন তো, আপনার স্ত্রী যদি নিজের চাকরির পাশাপাশি আপনার বাসায় রান্না না করেন, ঘর না সামলান, আপনাকে বলেন, "দুই ঘন্টা আমিও কামলা দেব, তুমিও দিবা" বা "একদিন আমি রান্না করব, একদিন তুমি", আপনি তাকে কী বলবেন? মানবেন এটা? আসলেই? তাঁকে যা বলা হবে, তা ভদ্র ভাষায় লেখার কায়দা আমার জানা নেই।
তিনি এমনটা না করে যখন ঘর সামলাবেন, চাকরি ছেড়ে দিবেন, সেই স্ত্রী যদি কোনোদিন, কোনো কারণে, ২০ বছরের বেশি সময় পরে আপনাকে ছেড়ে যায়, আপনি তাঁকে কী বলবেন, তা এতদিনে আপনার খুব ভালো করে বোধ হয় জানা হয়ে গেছে।
মেলিন্ডা বিলের স্ত্রী হওয়ার আগে একজন মানুষ। নিজ যোগ্যতাবলে তিনি যা করেছেন, সেটা থেকে তাঁর কাজ কীরকম হতে পারত, ক্যারিয়ার কেমন হতে পারত, তা বোঝা যায়। সেগুলো ছেড়ে দিয়ে তিনি নিজেকে বিলের স্ত্রী করে নিয়েছেন, বিলের সন্তানদের মা হিসাবে জীবন-যাপন করেছেন। বিলের সন্তানদের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে ৫৬ বছর বয়সী একজন মায়ের কথা ভাবুন তাঁকে নিয়ে অশোভন কথা লেখার আগে। এতে তাঁর চরিত্র প্রকাশ পায় না, আপনার চরিত্র প্রকাশ পায়।
আপনার মা, বোন এবং স্ত্রীকে আপনার সমান মানুষ বলে ভাবতে শিখুন। তাঁদের শুধু 'মা', 'বোন' বা 'স্ত্রী' ভাবা বন্ধ করুন। মানুষের মা, বোন, স্ত্রীদেরও মানুষ বলে ভাবার চেষ্টা করুন। তাঁরা মানুষ, তাঁদের একটা আলাদা সত্ত্বা আছে।
ভাবুন। ভাবা প্র্যাক্টিস করুন।
এতে অন্তত নিজের চরিত্র ও মানসিকতাটা বুঝতে পারবেন। মানুষ হতে পারবেন।
শুভরাত্রি।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow