অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য’
অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার বাণিজ্যের পরিচয় দিতে গিয়ে স্কটল্যাণ্ডবাসী ‘আলেকজান্ডার ডাফ’ লিখেছিলেন, “বাংলার নরম জলবায়ু, জমির উর্বরাশক্তি ও হিন্দুদের প্রকৃতিগত ঐতিহ্য বাণিজ্যের সহায়ক। শতাব্দীর প্রথমার্ধে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লেনদেনের পর বাংলার পক্ষে উদ্বৃত্ত (balance of trade) থাকত; এখানে যে সোনা বা রুপো বিদেশীরা নিয়ে আসতেন তা আর কখনো ফেরত যেত না।” (দ্য হিস্ট্রি অব হিন্দুস্থান, ১ম খণ্ড, আলেকজান্ডার ডাফ, পৃ- ১০৩) একই প্রসঙ্গে ‘জে. গ্রোস’ লিখেছিলেন যে, ওই সময়ের বাংলা থেকে প্রতিবছরই পঞ্চাশ থেকে ষাটখানা জাহাজ ভর্তি করে পণ্যসম্ভার বিদেশে যেত। (ভয়েজ টু দি ইস্ট ইন্ডিজ, ২য় খণ্ড, জে. গ্রোস, পৃ- ২৩৮) প্রাক-পলাশী যুগের বাংলার বহির্বাণিজ্য বা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিমাণে বিশাল এবং প্রকৃতিতে বৈচিত্র্যপূর্ণ ছিল। তৎকালীন বাংলার আর্থ-সামাজিক জীবনে এর প্রভাব অপরিসীম ছিল। তখন সেই বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমেই বাংলা প্রচুর পরিমাণে অর্থোপার্জন করত।
অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার বাণিজ্যের পরিচয় দিতে গিয়ে স্কটল্যাণ্ডবাসী ‘আলেকজান্ডার ডাফ’ লিখেছিলেন, “বাংলার নরম জলবায়ু, জমির উর্বরাশক্তি ও হিন্দুদের প্রকৃতিগত ঐতিহ্য বাণিজ্যের সহায়ক। শতাব্দীর প্রথমার্ধে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লেনদেনের পর বাংলার পক্ষে উদ্বৃত্ত (balance of trade) থাকত; এখানে যে সোনা বা রুপো বিদেশীরা নিয়ে আসতেন তা আর কখনো ফেরত যেত না।” (দ্য হিস্ট্রি অব হিন্দুস্থান, ১ম খণ্ড, আলেকজান্ডার ডাফ, পৃ- ১০৩) একই প্রসঙ্গে ‘জে. গ্রোস’ লিখেছিলেন যে, ওই সময়ের বাংলা থেকে প্রতিবছরই পঞ্চাশ থেকে ষাটখানা জাহাজ ভর্তি করে পণ্যসম্ভার বিদেশে যেত। (ভয়েজ টু দি ইস্ট ইন্ডিজ, ২য় খণ্ড, জে. গ্রোস, পৃ- ২৩৮) প্রাক-পলাশী যুগের বাংলার বহির্বাণিজ্য বা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিমাণে বিশাল এবং প্রকৃতিতে বৈচিত্র্যপূর্ণ ছিল। তৎকালীন বাংলার আর্থ-সামাজিক জীবনে এর প্রভাব অপরিসীম ছিল। তখন সেই বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমেই বাংলা প্রচুর পরিমাণে অর্থোপার্জন করত। সেই সময়ের আন্তঃপ্রাদেশিক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রতিবছর লেনদেনের পরে বাংলার লাভের পরিমাণ এককোটি ষোল লক্ষ টাকার উপরে গিয়ে দাঁড়াত। (রানা চক্রবর্তী) উক্ত শতাব্দীর গোড়ার দিকে ‘আলেকজাণ্ডার হ্যামিলটন’ হুগলীকে বাংলার সবচেয়ে বড় আমদানি-রপ্তানি বন্দর বলে নিজের লেখায় উল্লেখ করেছিলেন। ওই সময়ে হুগলী ছিল ‘বক্সবন্দর’, তৎকালীন বাংলা সুবায় সেটিই মোঘল সম্রাটের সবচেয়ে বড় শুল্ক চৌকি ছিল। ১৭২৮ সালে হুগলী বন্দর থেকে দু’লক্ষ বিয়াল্লিশ হাজার ষোল সিক্কা টাকা আমদানি-রপ্তানি শুল্ক আদায় করা হয়েছিল। (এই হিসেবের মধ্যে হুগলীর পাশের ন’টি গঞ্জের শুল্কও ধরা হয়েছে।) তবে পলাশী যুদ্ধের সময় কলকাতা নিঃসন্দেহে বাংলার সবচেয়ে বড় বন্দর ছিল। সেই সময়ে কলকাতার লোকসংখ্যা ছিল প্রায় এক লক্ষ, এবং মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল এক মিলিয়ন পাউণ্ড বা এক কোটি টাকা। ওই শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইউরোপীয়দের মধ্যে ইংরেজ, ফরাসি, ওলন্দাজ, দিনেমার, জার্মানি ও বেলজিয়ামের অধিবাসীদের সঙ্গে বাংলার বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। সেই সময়ে গ্রীস ও পর্তুগালের সঙ্গেও বাংলার অল্প পরিমাণে বাণিজ্য চলত। ইউরোপীয়রা ছাড়া সেই যুগের বাংলার বহির্বাণিজ্যে বিদেশী বণিকদের মধ্যে আরব, চীনা, তুর্কী, ইরাণী, আবিসিনীয় জর্জীয় ও আর্মেনীয়দের দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। উক্ত সময়ে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত বাংলার অবাঙালী বণিক সমাজও বাংলার এশীয় বাণিজ্যে অংশ নিত। সেই অবাঙালী বণিকদের মধ্যে গুজরাটী, রাজস্থানী, পাঞ্জাবী, মালাবারী প্রমুখরা প্রধান ছিলেন। ওই শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে আমেরিকার বণিকদল বাংলায় বাণিজ্য করতে এসেছিল। (রানা চক্রবর্তী) ভৌগোলিক দিক থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে পাঁচভাগে ভাগ করা যেতে পারে - (১) পশ্চিম এশিয়ার লোহিত সাগর ও পারস্য উপসাগরের উপকূলভাগের দেশগুলি, যথা - আরব (জেদ্দা), ইরাক (বসরা, বুশায়ার, বন্দর রিগ), ইয়েমেন (মোখা), ওমান (মসকট) ও ইরাণ (গোম্বুন - ইংরেজদের বন্দর আব্বাস)। তখন জেদ্দার মধ্যে দিয়ে মিশর ও অটোমান তুর্কী সাম্রাজ্যের বন্দরগুলি, এবং বসরার মধ্যে দিয়ে সিরিয়ার আলেপ্পোর সঙ্গে বাণিজ্য চলত। (২) বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের দেশগুলি, যথা - ব্রহ্মদেশ, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপপুঞ্জ। (৩) দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ও সুদূর প্রাচ্যের দেশগুলি, যথা - ইন্দোনেশিয়া (বাটাভিয়া), সুমাত্রা (অচিন, বেঙ্কলীন), বোর্ণিও, মালয় (কেদা), ম্যানিলা (ফিলিপিন) ও চীন (ক্যানটন)। (৪) আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের কেনিয়া (পেত, Pate), পর্তুগীজ উপনিবেশ মোজাম্বিক, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা। (৫) ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স, হল্যান্ড, ডেনমার্ক, জার্মানি ও বেলজিয়াম (তৎকালীন অস্ট্রিয়ার নেদারল্যান্ড)। তৎকালীন ভারতের পশ্চিম উপকূলের সুরাট বন্দরের মধ্যে দিয়ে তখন পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে বাংলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিচালিত হত। ওই সময়ে বাংলা থেকে প্রধানতঃ বিভিন্ন প্রকারের সুতীবস্ত্র, মসলিন, রেশম, চাল ও চিনি ওই অঞ্চলে সরবরাহ করা হত। আর ওই অঞ্চলগুলি থেকে বাংলায় তামা, ঘোড়া, খেজুর, বাদাম, সিরাজীমদ, গোলাপজল প্রভৃতি আসত। বাংলা ও পারস্য উপসাগরের তীরবর্তী দেশগুলির মধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তখন আর্মেনীয় বণিকদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। পারস্যের রাজধানী ইস্পাহানের কাছে অবস্থিত জালফাতে তখন তাঁদের উপনিবেশ ছিল। ওদিকে বঙ্গদেশের মুর্শিদাবাদের কাছে পৈদাবাদ ও কলকাতা সেই সময়ে তাঁদের একটি বড় বাণিজ্য ঘাঁটি ছিল। উক্ত সম্প্রদায়ের অনেকেই বেশ ধনী ছিলেন, এবং ব্যবসা বাণিজ্য তাঁদের জাতিগত ঐতিহ্য ছিল। (আর্মেনিয়ানস ইন ইন্ডিয়া, এম. জে. শেঠ) তখন ওই অঞ্চলের বাণিজ্যের অপর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল যে, সেই সময়ে বাংলা পণ্যের একাংশ জল ও স্থলপথে মিশর, সিরিয়া ও অটোমান তুর্কী সাম্রাজ্যের বিভিন্ন শহর ও বন্দরগুলিতে পুনরায় রপ্তানি (re-export) করা হত। তখন লোহিত সাগরের উপকূলে অবস্থিত জেদ্দা ও মোখাতেও বাংলার বাণিজ্য চলত। ওই অঞ্চলে বাংলার মসলিন, অন্যান্য সুতীবস্ত্র, চাল ও চিনি বিক্রি করা হত। আর সেই অঞ্চল থেকে তখন বাংলা তার পণ্যের বিনিময়ে সোনা ও রুপো নিয়ে আসত। (রানা চক্রবর্তী) অষ্টাদশ শতাব্দীর চল্লিশের দশক পর্যন্ত পারস্য উপসাগর ও লোহিত সাগরের উপকূলভাগের দেশগুলির সঙ্গে বাংলার বাণিজ্য বেশ ভালরকমভাবেই চালু ছিল। কিন্তু তারপর থেকেই আস্তে আস্তে সেই বাণিজ্যে মন্দা দেখা দিয়েছিল। এরপরে অষ্টাদশ শতকের সত্তরের দশক থেকে সেই বাণিজ্য নামমাত্র টিকে ছিল বলা যায়। উক্ত সময়ে পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে বাংলা বাণিজ্যের অবনতির তিনটি কারণ ইতিহাস থেকে লক্ষ্য করা যায়, সেগুলি হল - (ক) অষ্টাদশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক থেকে ওই অঞ্চলগুলিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়েছিল। ইরাণে আফগান আক্রমণ, রাশিয়া ও তুরস্কের বিরুদ্ধে ইরাণের যুদ্ধ, নাদির শাহের শাসন এবং জান্দ ও কাজারদের মধ্যে লড়াই পারস্যের শান্তি ও বাণিজ্যিক পরিবেশ - দুটোকেই তখন নষ্ট করে দিয়েছিল। ওই সময়েই ইরাকে বাসাদের নেতৃত্বে তুরস্কের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল। যার ফলে বসরা বন্দরের বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, এবং বসরা ও কায়রোর মধ্যে থাকা বাণিজ্য পথটি রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেই সময়ে বসরা ও সিরিয়ার মধ্যে বাণিজ্যও অচল হয়ে পড়েছিল। তখন ইয়েমেনেও গৃহযুদ্ধ দেখা দিয়েছিল। তাই এককথায় বলা যায় যে, ওই সময়ে সমগ্র পারস্য উপসাগর ও লোহিত সাগরের তীরবর্তী দেশগুলি বিভিন্ন ধরণের রাজনৈতিক অশান্তির শিকার হয়েছিল। (খ) সেই সময়ের লোহিত সাগরের তীরবর্তী বন্দরগুলির - জেদ্দা, মোখা, মস্কট বন্দর কর্তৃপক্ষের জুলুম ও জবরদস্তি করে টাকা আদায় করা, বাণিজ্য পণ্যের জন্য ন্যায্য দাম না দেওয়া, এবং বণিকদের পাওনা টাকা শোধ না করে ফেলে রাখাটা ওই অঞ্চলের বাণিজ্যের অনেকটাই ক্ষতি করেছিল। সেই সময়ে ওই অঞ্চলে বিদেশী জাহাজ আটক করে বাজেয়াপ্ত করবার ঘটনাও কম ঘটেনি। (গ) অষ্টাদশ শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে (১৭৪০) বঙ্গদেশে ভোগ্যপণ্য ও অন্যান্য পণ্যের দাম ক্রমাগত বাড়তে শুরু করেছিল। উক্ত সময়ে বাংলা ওই অঞ্চলে প্রধানতঃ তিনটি পণ্য সরবরাহ করত - সুতীবস্ত্র, রেশম ও চিনি। সেই সময়ে ওই অঞ্চলের বাজারে যেমন জাভা ও চীন থেকে সস্তা চিনি, এবং চীনদেশ থেকে সস্তা রেশম আসতে শুরু করেছিল (ডাচ এশিয়াটিক ট্রেড, কে. প্ল্যাম্যান, পৃ: ১৬০-৭০); তেমনি উক্ত শতাব্দীর তৃতীয় পাদে বাংলার সুতী বস্ত্রের দাম কমপক্ষে ৩০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল। এর ফলে বাংলা ওই অঞ্চলের বণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দ্রুত পরাজিত হতে শুরু করেছিল, এবং শেষপর্যন্ত ওই বাজারটি বাংলার হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। উক্ত শতাব্দীতে শ্রীলঙ্কা, ব্রহ্মদেশ ও মালদ্বীপের সঙ্গেও বাংলার বাণিজ্য চলত। সেই যুগের শ্রীলঙ্কা ওলন্দাজদের উপনিবেশ ছিল। (রানা চক্রবর্তী) ওলন্দাজরা সাধারণতঃ ইউরোপীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের তাঁদের নিজেদের কোন উপনিবেশে বাণিজ্যাধিকার দিতে রাজী হতেন না। কিন্তু ওলন্দাজদের সেই বাধা নিষেধ সত্ত্বেও ওই সময়ের বঙ্গদেশ থেকে মাঝে মাঝেই শ্রীলঙ্কায় বাণিজ্য জাহাজ যেত। তখন মালদ্বীপ থেকে বঙ্গদেশ প্রচুর পরিমাণে কড়ি, শাঁখ ও দড়ি (coire) আমদানি করত। ব্রহ্মদেশের সিরিয়াম ও পেগু থেকে বঙ্গদেশে তখন টিন, প্রচুর পরিমাণে সাধারণ কাঠ, চন্দন ও সাপন কাঠ, মোম, হাতির দাঁত ও লাক্ষা আসত। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলার গৃহ নির্মাণ ও জাহাজ তৈরিতে ব্রহ্মদেশের কাঠ ব্যবহৃত হত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও সুদূর প্রাচ্যের সঙ্গে বাংলার বাণিজ্য সম্পর্ক বহু প্রাচীন হলেও, উক্ত শতকের গোড়ার দিকে সেই সম্পর্ক তেমন বিস্তৃত বা বিশাল ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকে উক্ত শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত সেই বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধির যুগ ছিল। এই প্রসঙ্গে ‘হোল্ডেন ফারবার’ (Holden Furber) মন্তব্য করেছিলেন যে, পশ্চিম এশিয়াতে বাংলা বাণিজ্যে অবনতি শুরু হওয়ার সময় থেকেই পূর্বাঞ্চলে শ্রীবৃদ্ধি দেখা দিয়েছিল। সেই ঘটনাটিকে তিনি ‘বাণিজ্য বিপ্লব’ (Commercial revolution) বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। তবে ‘পি.জে. মার্শাল’ সেই দুটি ঘটনার মধ্যে অন্ততঃ তিরিশ বছরের (১৭৪০-১৭৭০) ব্যবধান লক্ষ্য করেছিলেন। (ইস্ট ইণ্ডিয়ান ফরচুনস: দ্য ব্রিটিশ ইন বেঙ্গল ইন দি এইটিনথ সেঞ্চুরি, পি. জে. মার্শাল, পৃ- ১০৪) তখন বাংলা থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে - ইন্দোনেশিয়া, মালয়, সুমাত্রা, বোর্ণিও, ফিলিপিন ও ইন্দোচীনে - সাধারণতঃ আফিম, বিভিন্ন ধরনের সুতীবস্ত্র, রেশম ও অন্যান্য দ্রব্য রপ্তানি করা হত। বিনিময়ে সেই অঞ্চল থেকে বাংলায় টিন, লঙ্কা, মোম ও নানারকমের মশলা, যথা - জৈত্রি, জায়ফল, এলাচ, দারুচিনি প্রভৃতি আমদানি করা হত। সেই সময়ে ওই অঞ্চলের সাথে ব্যবসার প্রধান অসুবিধা ছিল যে, তখন ফিলিপিনের রোমান ক্যাথলিক কর্তৃপক্ষ প্রোটেস্টান্ট বণিকদের সেখানে বাণিজ্য করতে দিতেন না। তাই ইংরেজ বণিকেরা আর্মেনীয় ও পর্তুগীজ বণিকদের নামে সেখানে ব্যবসা করতেন। সেখান থেকে স্পেনদেশের মধ্যে দিয়ে পাওয়া মেক্সিকো রূপো তখন বাংলায় আসত। (রানা চক্রবর্তী) ঠিক একইভাবে বাটাভিয়াতে তখন ওলন্দাজরা তাঁদের ইউরোপীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের সহ্য করতে পারতেন না। ওই সময়ে তাঁরা নিজেদের আশেপাশের স্বাধীন বা আধা-স্বাধীন সুলতানদের উপরে বাণিজ্যিক একাধিপত্য স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন, এর ফলে ওই অঞ্চলের বাণিজ্যও অনেকাংশে ব্যাহত হয়েছিল। কিন্তু তখন ওলন্দাজদের বাধাধান সত্ত্বেও বাংলার জাহাজ সেলাঙ্গর (Selangor), রিয়াও (Riau), প্যালেম্ব্যাঙ্গ (Palem- bang) ও ট্রেঙ্গানুতে (Terengganu) ব্যবসা করত। উক্ত জায়গাগুলির সবই মালয় ও মালাক্কা প্রণালীর কাছাকাছি ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর ক্যান্টন বন্দরের মাধ্যমে চীনদেশের সঙ্গে বাংলার বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সেই সময়ে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি চীনদেশ থেকে চা কিনতে শুরু করেছিল, এবং কোম্পানির কর্মচারীরা তাঁদের নিজেদের দেশে টাকা পাঠানোর জন্য কোম্পানির ক্যান্টন ট্রেজারিতে টাকা জমা দিয়ে লন্ডনের উপরে ‘বিল অব এক্সচেঞ্জ’ গ্রহণ করতে শুরু করেছিলেন। উক্ত সময়ের কোম্পানির কর্মচারীরা ক্যান্টন বন্দরে প্রচুর পরিমাণে আফিম বিক্রি করে সেই টাকা সংগ্রহ করেছিলেন। উল্লেখ্য যে, ওই সময়ের চীনদেশে আফিমের ব্যবসা সরকারিভাবে স্বীকৃত ছিল না বলে কোম্পানি নিজে সরাসরিভাবে সেই ব্যবসায়ে নামতে পারেনি। তখন বাংলার জাহাজগুলি চীনদেশে আফিম ছাড়া কাঁচাতুলা, লঙ্কা ও টিন নিয়ে যেত। চীনদেশের সাথে বাণিজ্যের জন্য তখন মালাবার উপকূল থেকে লঙ্কা, গুজরাট থেকে তুলা, এবং পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে টিন সংগ্রহ করা হত। (রানা চক্রবর্তী) অন্যদিকে সেই সময়ের ক্যান্টন বন্দর থেকে বাংলার জাহাজগুলি বিভিন্ন ধরনের জিনিস নিয়ে আসত। সেগুলির মধ্যে তুতেনাগ (দস্তা ও তামার মিশ্র ধাতু), মোটা চিনি, চা, পোর্সলেনের বাসন ও ফিটকিরি উল্লেখযোগ্য ছিল। (ইস্ট ইণ্ডিয়ান ফরচুনস: দ্য ব্রিটিশ ইন বেঙ্গল ইন দি এইটিনথ সেঞ্চুরি, পি. জে. মার্শাল, পৃ- ১০০) অষ্টাদশ শতকে আফ্রিকার সঙ্গেও বাংলার বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। (বেঙ্গল ইন ১৭৫৬-৫৭, ৩য় খণ্ড, এস. সি. হিল, পৃ- ৩৯০; ভয়েজ টু দি ইস্ট ইন্ডিজ, ২য় খণ্ড, জে. গ্রোস, পৃ- ২৩৫; এ ভিউ অব দি রাইজ, প্রগ্রেস এ্যান্ড প্রেজেন্ট স্টেট অব দি ইংলিশ গভর্ণমেন্ট ইন বেঙ্গল, এইচ. ভেরেলস্ট, পৃ- ৫৯) তখন কেনিয়া উপকূলে বাংলার জাহাজ নিয়মিতভাবে যাতায়াত করত। উক্ত শতকের মধ্যভাগে বাংলা থেকে কয়েকটি জাহাজ বাণিজ্য উদ্দেশ্যে সেই অঞ্চলে গিয়েছিল বলে ইতিহাস থেকে জানতে পারা যায়। সেখান থেকে জাহাজগুলি কড়ি সংগ্রহ করত। একই সময়ে আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের দক্ষিণাঞ্চলের পর্তুগীজ উপনিবেশ মোজাম্বিকেও বাংলার বাণিজ্য জাহাজের দেখা পাওয়া গিয়েছিল। তৎকালীন বাংলার জন্য আফ্রিকার ক্রীতদাস সংগ্রহ করাটা সেই বাণিজ্যের অন্যতম লক্ষ্য ছিল বলে মনে করবার ঐতিহাসিক কারণও রয়েছে। সেই যুগের ইউরোপীয় জাহাজ মালিকেরা দাস ব্যবসায়কে বেশ লাভজনক বলে মনে করতেন। উক্ত শতাব্দীর শেষের দিকে বাংলার জাহাজকে মাঝে মাঝে সুদূর অস্ট্রেলিয়াতে গিয়ে উপস্থিত হতেও দেখা গিয়েছিল। (রানা চক্রবর্তী) ওই সময়ে আমেরিকার বণিকেরাও ব্যবসা করবার উদ্দেশ্যে নিজেদের জাহাজ নিয়ে কলকাতায় আসতেন, ইংরেজ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিই তাঁদের সেই অধিকার দিয়েছিল। ওই শতাব্দীর প্রথমভাগে এশীয়দের স্বার্থেই বাংলার এশীয় বাণিজ্য পরিচালিত হত। কিন্তু ওই শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ ও চীনের সঙ্গে বাংলার বেশিরভাগ বাণিজ্যই সেই সময়ের ইংরেজ বণিকদের স্বার্থে গড়ে উঠেছিল। তখন কোম্পানির নিজের এবং কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসার প্রয়োজনেই সেই ব্যবসা গড়ে তোলা হয়েছিল। (ইস্ট ইণ্ডিয়ান ফরচুনস: দ্য ব্রিটিশ ইন বেঙ্গল ইন দি এইটিনথ সেঞ্চুরি, পি. জে. মার্শাল, পৃ- ১০৫) অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে তিনটি ইউরোপীয় কোম্পানিরই (ইংরেজ, ফরাসি ও ওলন্দাজ) সিংহভাগ অংশ ছিল। তখন বঙ্গদেশে ওই তিনটি কোম্পানিরই বাণিজ্যিক উপনিবেশ ও দুর্গ ছিল। ইংরেজদের কলকাতা ও ফোর্ট উইলিয়ম, ফরাসিদের চন্দননগর ও ফোর্ট আরলিও, এবং ওলন্দাজদের চুঁচুড়া ও ফোর্ট গুস্তাভাস তখনকার ইউরোপীয় বণিকদের বাংলা বাণিজ্যের প্রধান ঘাঁটি ছিল। এছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম, কাশিমবাজার, মালদা, রাজমহল, বর্ধমান, মেদিনীপুর, বীরভূম ও হুগলীতেও ওই তিন কোম্পানির আলাদা আলাদা ব্যবসাকেন্দ্র বা ফ্যাক্টরি ছিল। তাছাড়া তৎকালীন বঙ্গদেশের অন্যান্য শিল্প ও কৃষিপণ্যের উৎপাদন কেন্দ্রেগুলিতেও তাঁদের নিজস্ব কুঠি ছিল। (দি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ্যান্ড দি ইকনমি অব বেঙ্গল: ১৭০৪-১৭৪০, এস. ভট্টাচার্য্য, পৃ: ১০-১৫) ইতিহাস বলে যে, এদেশের রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে বাণিজ্যিক স্বার্থেই ইউরোপীয়দের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তখন প্রতিটি কোম্পানিরই একটি করে নিজস্ব বণিকগোষ্ঠীও বঙ্গদেশে গড়ে উঠেছিল। তৎকালীন বঙ্গদেশে ইউরোপীয় বণিকদের বাণিজ্যিক মূলধনের কোনো অভাব হত না। ওই সময়ে দরকার পড়লে তাঁরা এদেশের বণিক ও মহাজনদের কাছ থেকে যেমন স্বচ্ছন্দে টাকা ধার নিতে পারতেন, তেমনি জগৎশেঠ পরিবারের নিয়োজিত পুঁজির যোগানও তাঁদের জন্য বরাদ্দ ছিল। শেঠ পরিবারের সুদের হারও খুব একটা চড়া ছিল না। ওই সময়ে জগৎশেঠরা বার্ষিক ৯ শতাংশ হারে বিদেশী বণিকদের টাকা ধার দিতেন। উক্ত শতাব্দীর শেষর দিকে বেনারসের বণিকগোষ্ঠী (গোপাল দাস ও হরিকিষেণ দাস, মনোহর দাস, দ্বারকাদাস), পাঞ্জাবী (হুজুরিমল), আর্মেনীয় (খাজা ওয়াজেদ), রাজস্থানী এবং বাংলার শেঠ ও বসাক বণিকেরা ইউরোপীয় বণিকদের বাণিজ্যিক মূলধন সরবরাহ করতেন। তখন বৈদেশিক বাণিজ্যের সেই প্রয়োজনীয় আর্থিক দিকগুলি ছাড়াও তৎকালীন বাংলায় ইউরোপীয় রাজাদের উপযোগী অঢেল সুতীবত্র, মসলিন, রেশম এবং বিহারের সোরা পাওয়া যেত। সেই পণ্যগুলি গুণগত মানে উন্নত অথচ দামে সস্তা ছিল। (রানা চক্রবর্তী) তৎকালীন বাংলা থেকে রপ্তানি বাণিজ্যে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির বেশ ভালোই লাভ হত। উক্ত শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে তাঁরা বঙ্গদেশ থেকে সুতীবস্ত্রের রপ্তানি কমিয়ে কাঁচ, রেশম, তুলা, চিনি, নীল, শণ, পাট, তামাক প্রভৃতি ইউরোপে রপ্তানি করতে শুরু করেছিলেন। (দি ইকনমিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল, ১ম খণ্ড, এন. কে. সিংহ, পৃ- ২৯) অষ্টাদশ শতকের আশি ও নব্বই এর দশকে বঙ্গদেশ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যেখানে কাঁচা রেশম ৮ টাকা সের দরে কিনত, সেখানে সেই একই সময়ে লণ্ডনের বাজারে সেটির দাম ছিল ২৩ টাকা সের। (দি ইকনমিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল, ১ম খণ্ড, এন. কে. সিংহ, পৃ: ১৭৭, ১৯১, ২১৪-১৫; উক্ত সময়ে বঙ্গদেশে কাঁচা রেশমের দাম মাঝে মাঝে ৯ টাকে থেকে ১২ টাকা পর্যন্ত উঠে যেত।) তখন সোনামুখী থেকে কোম্পানি প্রতিখণ্ড গরা কাপড় তিন টাকা বারো আনা দামে কিনে ইউরোপের বাজারে বাইশ টাকা বারো আনা দামে বিক্রি করত। ওই সময়ের ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি বিহারের সোরা প্রতিমণ ২ টাকা ১৩ আনা ১ পয়সা হিসেবে কিনত, এবং কমিশনসহ সব খরচ মিলিয়ে তাঁদের দাম পড়ত ২ টাকা ১১ আনা। অথচ সেই পণ্যই ইউরোপে বিকি করে কোম্পানিগুলি প্রচুর মুনাফা করত। তবে সমগ্র অষ্টাদশ শতাব্দী জুড়ে ইংরেজ, ফরাসি ও ওলন্দাজদের বাংলা বাণিজ্যের পরিস্থিতি কিন্তু একই রকমের ছিল না। ওই গোটা শতাব্দী জুড়ে ফরাসিদের বাংলা বাণিজ্য নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। রাজা চতুর্দশ লুইয়ের রাজত্বের শেষের দিকে স্পেনের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত যুদ্ধ (১৭০২-১৭১৩), রিজেন্সি কাউন্সিলের বাংলার বাণিজ্য সম্পর্কে নিস্পৃহতা, সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধ (১৭৫৬-৬৩), ক্লাইভ কর্তৃক চন্দননগর অধিকার, আমেরিকার স্বাধীনতা সংক্রান্ত যুদ্ধ (১৭৭৮-৮৩), এবং একেবারে শেষের দিকে বিপ্লবী যুদ্ধের (১৭৯২-৯৯) ফলে ফরাসিদের বাংলা বাণিজ্য তেমনভাবে জোরালো হয়ে উঠতে পারেনি। শুধুমাত্র চন্দননগর ‘ডু প্লে’র অধীনে থাকাকালীন (১৭৩১-৪১) সেই বাণিজ্যে কিছুটা প্রাণের সঞ্চার ঘটেছিল। কিন্তু তাঁর পণ্ডিচেরি গমনের পরেই বাংলার ফরাসি বাণিজ্যে আবার মন্দাভাব দেখা দিয়েছিল। উক্ত শতাব্দীর শুরুতে ইউরোপীয়দের মধ্যে ওলন্দাজরা বাংলা বাণিজ্যের প্রধান পক্ষ ছিলেন। সেই সময়ের বাংলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অনেকটাই তাঁদের হাতে ছিল। ওই শতাব্দীর মধ্যভাগে পলাশীযুদ্ধের পরে ওলন্দাজরা বাটাভিয়াতে মশলার ব্যবসার দিকে বেশি ঝুঁকেছিলেন, সেই ব্যবসা তখন বেশ লাভজনক ছিল। (দি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ্যান্ড দি ইকনমি অব বেঙ্গল: ১৭০৪-১৭৪০, এস. ভট্টাচার্য্য, পৃ- ৭) আর সেই সময় থেকেই ইংরেজরা বাংলার রাজশক্তিকে হাতে পাওয়ার ফলে তৎকালীন বাংলার আন্তর্জাতিক বাজারের দুটি প্রধান পণ্য - আফিম ও সোরা - তাঁরা নিজেদের কুক্ষিগত করে নিয়েছিলেন। উক্ত শতাব্দীর দ্বিতীয়ভাগেও ওলন্দাজরা তাঁদের বাংলা বাণিজ্যকে ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগিতায় কোনমতে চালিয়ে গেলেও, ঠিক ওই সময়েই বাংলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সিংহভাগই ইংরেজদের হাতে চলে গিয়েছিল। (রানা চক্রবর্তী) প্রাক-পলাশীযুগে ইংরেজ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি বঙ্গদেশে বিনাশুল্কে বাণিজ্য করবার অধিকার লাভ করেছিল। ১৭১৭ সালে মোঘল সম্রাট ‘ফারুখসিয়ার’ একটি আদেশনামা বা ফারমান জারি করে কোম্পানিকে যে বাণিজ্যিক সুবিধাগুলি দিয়েছিলেন সেগুলি ছিল - (১) বার্ষিক ৩,০০০ টাকার বিনিময়ে বঙ্গদেশে বিনাশুল্কে বাণিজ্য করবার অধিকার; (২) কলকাতার পাশে আরো ৩৮টি গ্রামের জমিদারি স্বত্ত্ব কেনবার অধিকার; (৩) বাংলার রাজশক্তিকে দিল্লী থেকে নির্দেশ পাঠানো হয়েছিল যে, কোম্পানির পণ্য চুরি হলে চোর ধরে শাস্তি দিতে হবে, এবং কোম্পানির চুরি যাওয়া পণ্য ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে; (৪) কোম্পানির মাদ্রাজ টাকার (মাদ্রাজ আর্কট) উপরে কোন বাট্টা নেওয়া চলবে না; (৫) সবসময় বাদশাহী ফারমানের মূল কপি দাবী করা চলবে না, কাজীর প্রত্যয়িত কপি দেখালে যথেষ্ট হবে; (৬) কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঋণীব্যক্তি বা কর্মচারীরা পলাতক হলে তাঁকে আটক করে কোম্পানির হাতেই তুলে দিতে হবে; (৭) ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ইংরেজ জাহাজ বাজেয়াপ্ত করা চলবে না, বরং সেরকম ক্ষেত্রে ইংরেজদের সাহায্য করতে হবে; (৮) কোম্পানির পণ্যতরীর সঙ্গে প্রেসিডেন্টের সহিযুক্ত ‘দস্তক’ থাকলে তরী আটক বা অনুসন্ধান - কোনটাই করা চলবে না; (৯) বাংলা সরকারের অসুবিধা না হলে বাংলার টাঁকশালে কোম্পানিকে সোনা-রুপো টঙ্কনের অধিকার দিতে হবে। সম্রাট ফারুখসিয়ারের সেই ফারমানকে বঙ্গদেশে ইংরেজ কোম্পানির মহাসনদ বা ‘ম্যাগনাকার্টা’ (Magna Carta) বলে ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়েছে। (দি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ্যান্ড দি ইকনমি অব বেঙ্গল: ১৭০৪-১৭৪০, এস. ভট্টাচার্য্য, পৃ: ২০-২১) এরফলে সেই সময়ে কোম্পানি বেশ কিছু সুবিধা পেয়েছিল। প্রথমতঃ, তখনকার অন্যান্য ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির সঙ্গে তুলনায় ওই বাদশাহী ফারমানের ফলে ইংরেজ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি অনেকগুলি বাড়তি বাণিজ্যিক সুযোগ সুবিধা পেয়েছিল, এবং এরপর থেকেই কোম্পানির বাণিজ্য দ্রুত বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছিল। দ্বিতীয়তঃ, সম্রাট শাহজাহানের সময় থেকে ইংরেজ কোম্পানি বঙ্গদেশে যে সুযোগ সুবিধাগুলি ভোগ আসছিল, ওই নতুন ফারমানে সেগুলি আইনগত স্বীকৃতি পেয়েছিল। তৃতীয়তঃ, বাদশাহী ফারমানে কর্মচারীদের ক্ষেত্রে যে বিশেষ অধিকারগুলি কোম্পানি পেয়েছিল, সেটা থেকে বলা যায় যে, ওই সময়ে কোম্পানি বঙ্গদেশে অতি-আঞ্চলিক অধিকার (extraterritorial privileges) লাভ করেছিল। বাংলার তৎকালীন নবাব ‘মুর্শিদকুলি খাঁ’ ওই বাদশাহী ফারমান অনুযায়ী কোম্পানিকে সরকারি আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বিনাশুল্কে করতে দিতে রাজী হলেও, কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসাকে সেটার অন্তর্ভুক্ত করতে দেন নি। কোম্পানিকে কলকাতার পাশে আরো আটত্রিশটি গ্রাম কেনবার অধিকার দেওয়ার ব্যাপারটা মনঃপুত হয়নি। কিন্তু তাঁর বাধাদান সত্ত্বেও কোম্পানি তখন সেই গ্রামগুলিকে বেনামে কিনে নিতে সক্ষম হয়েছিল। তবে মুর্শিদাবাদের টাঁকশাল ব্যবহার করবার অধিকার কোম্পানি কখনোই পায়নি, আর কোম্পানির মাদ্রাজ টাকার উপরে ধার্য বাট্টার প্রশ্নটিও তখন অমীমাংসিত থেকে গিয়েছিল। (রানা চক্রবর্তী) প্রাক-পলাশীযুগে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির বাংলা বাণিজ্যের ধরন (pattern) অনেকটা প্রায় একই রকমের ছিল। তখন বিদেশী কোম্পানিগুলি এদেশীয় বণিক, দালাল ও পাইকারদের মাধ্যমে পণ্য কেনবার আগাম ব্যবস্থা করত। সমকালে সেটির ইংরেজি নাম ছিল - ‘ইনভেস্টমেন্ট’ (investment); অর্থাৎ, পণ্য উৎপাদনের আগেই তাতে দাদন বা অগ্রিমের মাধ্যমে কেম্পানিগুলির অধিকার জন্মে যেত। তখন যাঁরা উৎপাদকদের দাদন দিয়ে কোম্পানির জন্য পণ্য সংগ্রহ করতেন, তাঁদের ‘দাদনি ব্যবসায়ী’ বলা হত। তাঁরা নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট দামে ও গুণগতমানে কোম্পানিগুলিকে পণ্য সরবরাহ করতে চুক্তিবদ্ধ থাকতেন। সেজন্য ওই দাদনি ব্যবসায়ীরা কমিশন পেতেন, এবং কোম্পানীগুলি আগেই পণ্যের দামের ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ তাঁদের আগাম দিয়ে দিত। কোম্পানিগুলির ওই ভাবে পণ্য কেনবার ব্যবস্থা ইতিহাসে চুক্তি ব্যবস্থা বা ‘কন্ট্রাক্ট সিস্টেম’ (contract system) নামে পরিচিত। ১৭০০ সাল থেকে ১৭৫৩ সাল পর্যন্ত ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি বঙ্গদেশে ওই ব্যবস্থার মাধ্যমেই বাণিজ্যের জন্য পণ্য কিনেছিল। কিন্তু উক্ত শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে সেই ব্যবস্থায় নানা ধরণের ত্রুটি বিচ্যুতি দেখা দিতে শুরু করেছিল। তখন কোম্পানি অগ্রিম দাম দিয়েও সময়মত পণ্য পেত না, পণ্যের নির্দিষ্টমান বজায় থাকত না আর দামও বেশি পড়ত। তখন থেকেই বাংলার দাদনি ব্যবসায়ীদের আর্থিক অবস্থা ক্রমশঃ খারাপ হতে শুরু করেছিল। এর উপরে তাঁদের উদ্ধত ব্যবহারও তখন কোম্পানিকে নিজেদের পণ্যক্রয়নীতি পরিবর্তনে বাধ্য করেছিল। (রানা চক্রবর্তী) ফলে ১৭৫৩ সাল থেকে কোম্পানি বঙ্গদেশ থেকে পণ্য কেনবার একটি নতুন ব্যবস্থা চালু করেছিল, সেই নতুন ব্যবস্থার নাম ছিল ‘এজেন্সি সিস্টেম’ (agency system); অর্থাৎ, কোম্পানি তখন সরাসরি নিজেদের এজেন্ট ও গোমস্তাদের মাধ্যমে উৎপাদকদের আগাম দেওয়া ও নির্দিষ্ট পণ্য সরবরাহের চুক্তি করত। ওই ব্যবস্থার ফলে তখন কোম্পানি ও উৎপাদকদের মাঝখানে দাদনি ব্যবসায়ীরা ছিলেন না। ১৭৫৩ সাল থেকে ১৭৭৫ সাল পর্যন্ত ওই ব্যবস্থার মাধ্যমেই কোম্পানি বঙ্গদেশ থেকে নিজেদের বাণিজ্যের জন্য পণ্য কিনেছিল। তার ফলে পলাশী-উত্তর যুগে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা অনেক পরিমাণে বেড়ে গিয়েছিল, এবং দস্তকের অপব্যবহার করে তাঁরা প্রচুর অর্থোপার্জন করতে শুরু করেছিলেন। ওই সময়ে কোম্পানির গোমস্তারা জবরদস্তি ব্যবসা করে বাংলার তাঁতিদের সেই সময়ের প্রচলিত বাজার দর থেকে ৩০, ৪০ বা ৫০ শতাংশ পর্যন্ত দাম কম দিয়েছিলেন। (দি ইকনমিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল, ১ম খণ্ড, এন. কে. সিংহ, পৃ- ১২) ১৭৭০ সাল পর্যন্তু কোম্পানির ‘আড়ঙ কমিটি’ বঙ্গদেশের বাণিজ্যিক বিনিয়োগ দেখাশোনা করেছিল, এরপরে ‘কন্ট্রোলিং কমিটি অব কমার্স’ সেই দায়িত্ব পেয়েছিল। তাঁরা ‘কন্ট্রোলার অব ইনভেস্টমেন্ট’ কমিটির সঙ্গে একযোগে সেই তদারকির দায়িত্ব পালন করতেন। ১৭৭৪ সালের ২৯শে মার্চ তারিখ থেকে ‘বোর্ড অব ট্রেড’ কোম্পানির বাণিজ্য পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিল, এবং এরপরে উক্ত শতাব্দীর শেষপর্যন্ত সেই ব্যবস্থাই চালু ছিল। ১৭৭৫ সাল থেকে বোর্ড অব ট্রেড কোম্পানির কর্মচারীদের সঙ্গে ‘কন্ট্রাক্ট সিস্টেম’ বা চুক্তির মাধ্যমে পণ্য সরবরাহের ব্যবস্থা চালু করেছিল। তখন এদেশীয় বণিকেরা কোম্পানির কর্মচারীদের সহযোগী হিসাবে কোম্পানির পণ্য সংগ্রহ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ওই সময়ে নিজেদের আয়ের একাংশ তাঁরা কোম্পানির কর্মচারীদের তুলে দিতে বাধ্য থাকতেন। তবে স্বাধীন দাদনি বণিক হিসাবে তাঁরা তখন সরাসরি কোম্পানির সঙ্গে কোন চুক্তি করতে পারতেন না। সেই ব্যবস্থায় কোম্পানির সংগৃহীত রপ্তানি পণ্যের দাম বাড়লেও গুণগতমানে ঘাটতি দেখা গিয়েছিল। (রানা চক্রবর্তী) শেষে বোর্ড অব ট্রেডের কাজকর্মে নানা প্রকারের দুর্নীতি দেখা দেওয়ার ফলে লর্ড কর্ণওয়ালিশ উক্ত বোর্ডের সদস্য সংখ্যা এগারোজন থেকে কমিয়ে পাঁচজন করে দিয়েছিলেন, এবং পণ্য সংগ্রহ ব্যবস্থায় দুর্নীতি দূর করবার উদ্দেশ্যে ১৭৮৮ সালে পুনরায় এজেন্সি সিস্টেম চালু করেছিলেন। তাছাড়া কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে, বর্ধিত বেতন ও কমিশন দিয়ে তিনি কোম্পানির বাণিজ্য দুর্নীতিমুক্ত করবারও একটা চেষ্টা করেছিলেন। প্রাক-পলাশী যুগে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ইউরোপ থেকে বঙ্গদেশে প্রধানতঃ সোনা ও রুপো নিয়ে আসত। পলাশীর যুদ্ধ পর্যন্ত বাংলায় তাদের আমদানিকৃত মোট পণ্যের ৭৪ শতাংশই ওই দুই ধাতু ছিল। কিন্তু পলাশীর পরে বঙ্গদেশ থেকে পণ্য কেনবার জন্য কোম্পানির পুঁজি হিসাবে আর সোনা-রুপো আনবার দরকার পড়েনি। ১৭৬০ সালের মধ্যে তারা চব্বিশ পরগনা, বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রামের জমিদারি পেয়েছিল; ১৭৬৫ সালে দেওয়ানি লাভের সঙ্গে সঙ্গেই বাংলার উদ্বৃত্ত রাজস্ব (surplus revenue) তাদের বাণিজ্যের পুঁজি হয়ে উঠেছিল। এই প্রসঙ্গে ১৭৬৫ সালের তিরিশে সেপ্টেম্বর তারিখের একটি চিঠিতে ‘লর্ড ক্লাইভ’ লণ্ডনের ডিরেক্টর সভাকে লিখেছিলেন, “দেওয়ানি নেওয়ার ফলে বছরে আড়াই কোটি টাকা আয় হবে। এই আয় পরে আরো ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা বাড়বে। সাধারণ শাসন ও সামরিক ব্যাপারে বছরে ৬০ লাখ টাকা ব্যয় হবে। নবাবের ভাতা কমিয়ে ৪২ লাখ করা হয়েছে, মোঘল দরবারে ২৬ লাখ টাকা দিতে হবে। এই এককোটি ২৮ লাখ টাকা বাদ দিয়ে নীট লাভ এককোটি ২২ লাখ টাকা কোম্পানির হাতে থাকবে।” ১৭৭৩ সালে কোম্পানি শাসনের যে রিপোর্ট ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পেশ করা হয়েছিল, তাতে দেখা দিয়েছিল যে, ওই সময়ে কোম্পানির মোট এক কোটি ৩০ লক্ষ ৬৬ হাজার ৭৬১ পাউন্ড আয় হয়েছিল, ব্যয় হয়েছিল ৯০ লক্ষ ২৭ হাজার ৬০৯ পাউন্ড, এবং মোট ৪০ লক্ষ ৩৭ হাজার ১৫২ পাউন্ড বঙ্গদেশ থেকে ইংল্যাণ্ডে পাঠানো হয়েছিল। তখন ভারত থেকে আমদানি করা সব পণ্যের দাম কোম্পানির হাতে রাজস্ব বাবদ মুনাফার দ্বারা মেটানো যেত। এই প্রসঙ্গে ১৭৮৩ সালের সিলেক্ট কমিটির নবম রিপোর্টে স্বীকার করা হয়েছিল যে, বিনিময়ে কিছু না দিয়েই ভারত থেকে আমদানিকৃত পণ্য ইংল্যাণ্ডে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। (রানা চক্রবর্তী) অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বঙ্গদেশে ব্রড ক্লথ (সুতি ও পশমের মিশ্র একধরনের ঝকমকে কাপড়), পশমের কাপড়, দস্তা, সীসা, লোহা, টিন, তামা, পারদ এবং ঔষুধপত্র ও অন্যান্য ছোটখাট জিনিস নিয়ে আসত। ওই সময়ে কোম্পানি তার আমদানি করা কাপড় বাংলায় বিক্রি করবার, এবং সেই পণ্যের বাজার তৈরি করবার ব্যাপারে খুব ইচ্ছা ও উৎসাহ দেখিয়েছিল। কিন্তু তাদের আমদানি করা কাপড় অবশ্য বঙ্গদেশে বেশি বিক্রি করা সম্ভব হয়নি, ফলে সেগুলি বছরের পর বছর ধরে গুদামে পড়ে ছিল। (লেটার টু দি কোর্ট, ৮ই ডিসেম্বর, ১৭৫৫ সাল) তবে ইংরেজ কোম্পানির অন্যান্য পণ্যগুলির মধ্যে ধাতু ও ধাতব পণ্যগুলি বাংলার বাজারে বেশ ভালই বিক্রি হত; কিন্তু সেক্ষেত্রে তাদের ওলন্দাজ ও ফরাসিদের প্রতিদ্বন্দিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তাঁরাও অনুরূপ পণ্য বাংলার বাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে আসতেন। ওই সময়ে কোম্পানির রপ্তানি বাণিজ্যের লাভ তাদের আমদানি বাণিজ্যের লোকসানকে পুষিয়ে দিত। সেই যুগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা থেকে নানাধরনের সুতীবস্ত্র, রেশমবস্ত্র, কাঁচা রেশম, মসলিন ও সোরা ইংল্যাণ্ড ও ইউরোপীয় বাজারের জন্য সংগ্রহ করত। ১৭০০ ও ১৭২০ সালে ইংল্যাণ্ড নিজের পশম ও রেশমবস্ত্র শিল্পকে রক্ষা করবার জন্য সেখানে বাংলা তথা ভারতের সুতী ও রেশম বস্ত্রের আমদানিকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করেছিল; ওই কারণেই সেখানে তখন ভারতীয় এবং বাংলাবস্ত্রের উপরে উচ্চহারে আমদানি শুল্ক ধার্য করা হয়েছিল। তবে সমকালীন ইউরোপের বাজারে বাংলার সুতী ও রেশম বস্ত্রের চাহিদা থাকবার জন্য বাংলার বস্ত্রশিল্পের উপরে বৃটিশ সংরক্ষণ নীতির প্রভাব তেমন ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারেনি। সমগ্র অষ্টাদশ শতাব্দী জুড়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা থেকে রেশম কিনেছিল। ওই সময়ে ক্রমশঃ রেশম কেনবার পরিমাণ বাড়তে বাড়তে ১৭৩৪ সালে শেষপর্যন্ত দু’ লক্ষ ন হাজার একশো ছেষট্টি পাউণ্ডে গিয়ে পৌঁছেছিল। (দ্য ট্রেডিং ওয়ার্ল্ড অব এশিয়া এ্যান্ড দি ইংলিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি: ১৬৬০-১৭৬০, কে. এন. চৌধুরী, পৃ- ৫৩৪) এরপরে ১৭৫১ সাল থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত কোম্পানির বার্ষিক রেশম সংগ্রহের পরিমাণ চল্লিশ থেকে আশি হাজার পাউন্ডে পৌঁছে গিয়েছিল। উক্ত সময়ে কোম্পানি বাংলা থেকে সংগৃহীত আফিম চীন, জাভা ও মালয় দ্বীপপুঞ্জে পাঠাত। প্রাক-পলাশী যুগে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির বাংলা থেকে রপ্তানিকৃত বাণিজ্যের বার্ষিক পরিমাণ ছিল চব্বিশ লক্ষ টাকা। (দ্য ট্রেডিং ওয়ার্ল্ড অব এশিয়া এ্যান্ড দি ইংলিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি: ১৬৬০-১৭৬০, কে. এন. চৌধুরী, পৃ: ৫০৯-১০) ১৭০৮ সাল থেকে ১৭৫৬ সালের মধ্যে কোম্পানি বঙ্গদেশে ৫,১২,৪৮,১৮৪ টাকা দামের সোনারূপো; এবং ১,৮২,৭০,৭৪৪ টাকা মূল্যের বাণিজ্য পণ্য এনেছিল। উক্ত শতকের প্রথম বছরে কোম্পানির রপ্তানি বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৮,৯৬,৯৬৮ টাকা। (পাউন্ডের সঙ্গে টাকার বিনিময় হার, এক পাউন্ড সমান আট টাকা ধরে এই হিসাবটি করা হয়েছিল। প্রাক-পলাশী যুগে বিনিময় হার ছিল এক পাউন্ড সমান আট থেকে নয় টাকা, এবং উত্তর পলাশী যুগে এক পাউন্ড সমান দশ টাকা।) ওই শতকের মধ্যভাগে ১৭৫৫ সালে কোম্পানির রপ্তানি বাণিজ্য বেড়ে গিয়ে ৩২,৯২,০৪০ টাকায় পৌঁছেছিল। প্রাক-পলাশী যুগে ১৭৪২ সালে কোম্পানি বঙ্গদেশে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বাণিজ্য করেছিল। ঐ বছর কোম্পানির মোট রপ্তানি বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৪৪,৮৩,১৬০ টাকা। সেই সময়ে কোম্পানির শেয়ার মালিকেরা ৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ হারে লভ্যাংশ পেয়েছিলেন। (রানা চক্রবর্তী) সে যুগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মোট এশীয় বাণিজ্যের ৬০ শতাংশই বাংলার সঙ্গে হত। পলাশী-উত্তর যুগে বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তগত করবার পরে কোম্পানি কয়েকটি রপ্তানিকারক পণ্য - সুতীবস্ত্র, আফিম, রেশম, সোরা - এবং বাংলার অভ্যন্তরীণ বাজারের উপরে নিজের একাপিপত্য স্থাপনের চেষ্টা করেছিল। ওই সময়ে কোম্পানির কাছে বাণিজ্য করবার জন্য পুঁজির অভাব না থাকবার ফলে বঙ্গদেশে তাদের বিনিয়োগও অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল। ১৭৬৭ সালে কোম্পানির মোট রপ্তানি বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ষাট লক্ষ চালানি টাকা। এর ঠিক দশ বছর পরে কোম্পানির বাংলা থেকে রপ্তানি বাণিজ্যের পরিমাণ হয়েছিল এক কোটি টাকা। অষ্টাদশ শতকের আশি ও নব্বই-এর দশকে কোম্পানির গড় রপ্তানি বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল এক কোটি টাকা। ১৭৯১ ও ১৭৯৩ সালে কোম্পানির রপ্তানি বাণিজ্যের পরিমাণ, যথাক্রমে ১,০৬,০০,১০৯ ও ১,০৯,৫৯,১৩০ চালানি টাকা হয়েছিল। (দি ইকনমিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল, ১ম খণ্ড, এন. কে. সিংহ, পৃ- ১৮; ট্রেড এ্যান্ড ফিনান্স ইন দ্য বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি: ১৭৯৩-১৮৩৩, অমলেশ ত্রিপাঠী, পৃ: ৩৬-৩৭) উক্ত শতাব্দীর শেষ দুই দশকে কোম্পানির বাংলা বাণিজ্যের উপরে ইংল্যাণ্ডের শিল্প বিপ্লবের কিছু প্রভাব লক্ষ্য করা গিয়েছিল। প্রথমতঃ, ওই সময়ে কোম্পানি বাংলা থেকে ছাপা সুতীবস্ত্র আমদানি করা বন্ধ করে দিয়েছিল। দ্বিতীয়তঃ, ম্যানচেষ্টারে যন্ত্রশিল্পে প্রস্তুত মসলিন বাংলায় পরীক্ষামূলকভাবে আমদানি করা হয়েছিল। সেই মলিনের দাম বাংলার নিজস্ব মসলিন অপেক্ষা ২০ শতাংশ কম ছিল। তৃতীয়তঃ, যন্ত্রে প্রস্তুত উন্নত সুতো বাংলায় আমদানি করা হয়েছিল, ও বাংলা থেকে সুতো রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। চতুর্থতঃ, কোম্পানি সূতীবস্ত্রের পরিবর্তে (substitute) বাংলা থেকে কাঁচা তুলা, রেশম, চিনি, নীল, শন, পাট, তামাক প্রভৃতি রপ্তানি করবার কথা চিন্তা করতে শুরু করেছিল। অর্থাৎ, সুতীবস্ত্রের আমদানি অচিরেই বন্ধ হওয়া সম্পর্কে কোম্পানির তৎকালীন কর্তৃপক্ষের কোনো সন্দেহ ছিল না। সেই বিষয়ে মোটা সুতীবন্ত্রের উপরেই প্রথম আঘাত নেমে এসেছিল, এবং বাংলা থেকে সেটির রপ্তানি ক্রমশঃ কমতে শুরু করেছিল। তবে বঙ্গদেশ থেকে সূক্ষ্ম সুতীবস্ত্রের রপ্তানিতে উক্ত শতাব্দীতে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ঘাটতি দেখতে পাওয়া যায় নি। ওই সময়ে রেশম রপ্তানিতেও তেমন কোনো হেরফের ঘটেনি। ১৭৯৩ সালে কোম্পানি বঙ্গদেশ থেকে ৬৭,৬৮,৪০৮ টাকার ৮,৩৯,৯০৬ খণ্ড সুতীবস্ত্র, এবং ২৫,৮৬,৮৪৭ টাকা মূল্যের রেশম রপ্তানি করেছিল। ১৭৯৫ সালে রপ্তানি করা সুতীবস্ত্রের পরিমাণ ছিল ৮,৬৭,০৪০ খণ্ড। (দি ইকনমিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল, ১ম খণ্ড, এন. কে. সিংহ, পৃ- ১৮)
What's Your Reaction?