'এই মুহুর্তে' কী ঘটছে চরকিতে?

'এই মুহুর্তে' কী ঘটছে চরকিতে?

দ্য চরকি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পাওয়া ‘এই মুহূর্তে’ ফিল্মটিতে মূলত তিনটি গল্প বলা হয়েছে, অর্থাৎ তিন ভিন্ন পরিচালক নিজস্ব ভঙ্গিমায় নিজেদের গল্প বলেছেন। ফিল্মের প্রথম গল্পটি হচ্ছে মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত “কোথায় পালাবে রূপবান”।

রুপকথার গল্পের রূপবানের রুপকে এখানে তুলে ধরা হয়েছে একজন সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর মায়ের আকুতি। রুপকথার রূপবানকে যেমন রাজার আদেশে ১২ দিনের শিশুকে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বনবাসে যেতে হয়, এই গল্পের রূপবানও যেন সেই অসহায় মায়েরই প্রতিচ্ছবি। যে তার সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশুকে নিয়ে কঠিন বিপদের সম্মুখীন। ঘুমের মাঝেও সে স্বপ্ন দেখছে তার শিশুটিকে কেউ নিয়ে যাচ্ছে। এই মায়ের আশে পাশে খড়কুটো ধরে বাঁচার মত আশ্রয়ও নেই। শিশুর বাবাকে আমরা স্ক্রিনে দেখতে না পেলেও অসহায় রূপবানের ফোনালাপে আমরা আঁচ করতে পারি কতোটা ক্ষমতাধর এই পিতা! যে কোন কিছুর বিনিময়ে বাঁচতে দেবে না এই নিরপরাধ শিশুকে। রূপবানের অনেক আকুতি-মিনুতিও গলাতে পারে না সেই পাষণ্ড পিতার হৃদয়। অবশেষে মা তার শিশুকে বাঁচাতে এক খালার (হাসপাতালের আয়া) সহায়তায় কোন রকমে পালিয়ে যায় হাসপাতাল থেকে! কিন্তু সত্যিই কি পালাতে পারে রূপবান? একই সাথে এই গল্পে আমরা জ্যান্ত বাঘের চিড়িয়াখানা থেকে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাটিও দেখি। যেই বাঘের খোঁজে বের হয়েছে শিকারির দল। আবার পালিয়ে যাওয়া রুপবানকেও খুঁজতে থাকে ক্ষমতাধর কোন হায়েনার দল....গল্পের কোথায় একটা যেন এই দুইয়ের অসম্ভব সুন্দর এক মেলবন্ধন পাওয়া যায়। এই গল্পে রুপবান চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রিয়ন্তী উর্বি ! হাসপাতাল থেকে শুরু করে রাস্তায় রুপবানের অসহায়ত্ব সবটাই বেশ ভালোভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। বিশেষ করে হাসপাতালের এক শটে তার অভিনয় সত্যিই প্রশংসনীয়। অপরদিকে মহানগর ওয়েব সিরিজে দুর্দান্ত অভিনয় করা মোস্তাফিজুর নূর ইমরানকেও এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ে দেখি। তবে আমার কেন যেন মনে হয়েছে এখানে সে হয়তো নিজেকে সম্পূর্ণটা মেলে ধরতে সক্ষম হননি, কিংবা হয়তো তার চরিত্রটি সেভাবে ক্লিক করেনি। “কোথায় পালাবে রূপবান” গল্পটিতে আমাদের বর্তমান সমাজের সমসাময়িক ঘটনার প্রভাব বিদ্যমান। আমাদের চারপাশে এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যা দেখে বা তেমন কোন পরিস্থিতিতে আমরা বা আমাদেরই আশেপাশের মানুষজনের মুখের চোয়াল হা হয়ে যায়। ছোট একটি রুপক গল্পকে সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে এতো সুন্দর প্রেজেন্টশন আমাকে সত্যিই মুগ্ধ করেছে। পাশাপাশি উঠে এসেছে বর্তমান সময়ে চলমান হলুদ সাংবাদিকতার একটি বাস্তব উদাহরণও। গল্পের কোন কোন জায়গায় প্রথম দিকে আপনার মনে হতে পারে অর্থহীন কিংবা অসামঞ্জস্যপূর্ণ! কিন্তু আমার মনে হয়েছে নির্মাতা কাজটি ইচ্ছে করেই করেছেন। যাতে দর্শক নিজের মত কোন সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারেন..সেটা হোক ভালো কিংবা মন্দ! এই মুহুর্তে ফিল্মের দ্বিতীয় গল্পটি হচ্ছে নির্মাতা আবরার আতহার পরিচালিত 'ওয়ান পিস মেড কারিগর ইজ ডেড'। স্যাটায়ারধর্মী এই গুল্পে উঠে এসেছে আমাদের বর্তমান সময়ে ঘটে যাওয়া কিছু সিরিয়াস ঘটনা৷ ডার্ক কমেডি এই গল্পটি আপনাকে এক মুহুর্তের জন্যও বোরিং করবে না, বরং আপনার মনে হবে কোথায় যেন ঠিক এমনই কিংবা কাছাকাছি ঘটনার স্বাক্ষী হয়েছেন। একটু গভীরভাবে ভাবলে হয়তো আশেপাশের কিছু ঘটনার সাথে মিলও খুঁজে পাবেন। কিংবা আরও একটু গভীরে তলিয়ে দেখলে হয়তো খুঁজে পাবেন আমাদের সমাজেরই আংশিক প্রতিচ্ছবি৷ নির্মাতার শৈল্পিক ছোয়ায় যা আপনাকে দিবে গতানুগতিক ধারার বাইরে নতুন একটা স্বাদ। "একতাই হাতিয়ার বরাবরই আমাদের মূলমন্ত্র" এখানে আপনার সমস্যা আপনার একার না। এখানে আপনার সমস্যা আপনার,আমার, আমাদের সবার!" - সংলাপটি এই ফিল্মের হলেও এমন অঙ্গীকার আমরা হরহামেশাই শুনতে পাই আমাদের আশেপাশের কোন জনপ্রতিনিধি কিংবা নেতাদের মুখে মুখে৷ কিন্তু সত্যিই কেউ বিপদে পড়লে কয়জন পাশে পেয়েছে এসব জনপ্রতিনিধিদের? গল্পটিতেও এমন সব ইস্যুই বেশ সূক্ষভাবে তুলে ধরা হয়েছে৷ উঠে এসেছে হলুদ সাংবাদিকতা, সমাজে প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্য, এমনকি সেক্স'র মত ট্যাবু বিষয়ও। গল্পের চিত্রায়ণে নির্মাতা হয়তো অনেক সিনিয়র জুনিয়র অভিনয়শিল্পীদের মিলনমেলা বসিয়েছেন একই স্থানে৷ কারো মুখে সংলাপ ছিল, আবার কারো মুখে একেবারেই নয়। কিন্তু এক্সপ্রেশন দিয়েই এরা বুঝিয়ে দিয়েছেন চরিত্রগুলোর আলাদা সত্ত্বা। ঠিক-বেঠিক এর সংজ্ঞা যখন সম্পূর্ণটাই আপেক্ষিক, তখন সমাজের ভালো-মন্দের বিচারটা আসলে প্রতিটি বিবেকবান মানুষের কাঁধেই বর্তায়। কিন্তু সেই বিবেক-বুদ্ধির বিচারে আমরা কতোটা নৈতিক? চরকি প্ল্যাটফর্মে মুক্তিপ্রাপ্ত অ্যান্থোলজিক্যাল ফিল্ম এই মুহুর্তে' শেষ গল্প কল্পনা'য় উঠে এসেছে সেই নীতি-নৈতিকথার কথা। মানুষ হিসেবে যে আমরা কতোটা ভঙ্গুর এবং নৈতিক বিচারে মূল্যবোধহীন তা হয়তো সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে সহজেই অনুমেয়। নির্মাতা পিকলু আর খান সমাজের সেই অধঃপতন ও ভঙ্গুরতাকেই দারুণভাবে উপস্থাপন করেছেন সাম্প্রতিক সময়ে টিএসসিতে ঘটে যাওয়া একটি প্রেক্ষাপটে। গল্পের চিত্রায়ণে আমার কখনো ভিক্টিম মনে হয়েছে কল্পনা নামের মেয়েটিকে, কখনো মনে হয়েছে ফটোগ্রাফার দিব্যকে, আবার কখনো ইতালি ফেরত হাজি রুপে জাহিদ হাসানের সুরে বলতে ইচ্ছে করেছে উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ! ঘটনার সুক্ষ বুননে আপনার হয়তো কাউকেই দোষী মনে হবে না, প্রত্যেকেই ভিন্ন জায়গা থেকে পরিস্থিতিরই শিকার। যেই পরিস্থিতির পিছনে রয়েছে আপনার আমার মত পাবলিকের দৃষ্টিভঙ্গি। সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন ঘটনা- রটনা যারা হয়তো বুঝে কিংবা না বুঝেই ট্রল- দ্রুত ভাইরাল খেলায় মেতে উঠি, ভেবে দেখিনা ট্রল কিংবা ভাইরাল হওয়া সেই মানুষটির কথা। দীর্ঘদিন পর অভিনয়ে ফিরে সারা জাকের অভিনয়ে ফিরে দেখিয়ে দিলেন ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট। অপরদিকে জাহিদ হাসানের ওটিটি প্ল্যাটফর্মে আসাটা আমি ব্যক্তিগতভাবে চাচ্ছিলাম। তার সাবলীল অভিনয় সব সময় আমাকে মুগ্ধ করে। নতুন হলেও আমার কাছে মনে হয় এই গল্পে সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছে তটিনী নামের মেয়েটি। যার প্রতিটি এক্সপ্রেশন একদম পারফেক্ট ছিল। অভিনয়ে নিয়মিত হলে হয়তো আমরা তার কাছ থেকে আরও দারুণ কিছু পাব।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow