শিক্ষক বাবার বড় মেয়ে সুচরিতা। ভালোবেসে অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে বিয়ে করেন আরেক সংগ্রামী মানুষকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম তখন উত্তাল। চলছে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের আন্দোলন। বিয়ের কিছুদিন পরেই ভালবাসার মানুষ বেছে নেন অধিকতর সংগ্রামী জীবন। হয়ে যান গেরিলা যোদ্ধা। চলে যান আত্নগোপনে। একা হয়ে যান সদ্য বিবাহিত সুচরিতা। শুরু হয় একাকী জীবনের আরেক সংগ্রাম। বেঁচে থাকার জন্য শুরু করেন গ্রামের স্কুলের শিক্ষকতা। প্রায় বছর খানিক পরে নিরাপত্তার কারণে তিনিও চলে যান প্রিয় মানুষের কাছে, গভীর অরণ্যে। সে এক নতুন পৃথিবী। আরেক নতুন জীবন। কঠোর নিয়ম কানুন পালনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হতে থাকেন কঠিন সেই জীবনে। পার্টি প্রদত্ত সীমিত রেশনে চালিয়ে নিতে হয় পরিমিত ব্যয়ের সংসার। অবসর সময়ে সংসারের বাড়টি আয়ের জন্য কোমর তাঁতে কাপড় বুনেছেন, মুরগী পালন করেছেন। বাড়ির আঙিনায় সবজীর চাষ করেছেন। এসবই ছিল তার জীবনের জন্য এক একটা নতুন চ্যালেঞ্জ। সম্ভান্ত পরিবারের সদস্য সুচরিতা কষ্ট হলেও সব সামলে নিয়েছেন হাসিমুখে।
১৯৯৭ সালের শান্তি চুক্তির পরে গেরিলা জীবন ছেড়ে ফিরে আসেন স্বাভাবিক জীবনে। ফিরে এসেই এই সংগ্রামী দম্পতি মুখোমুখি হলেন আরও অনেক চ্যালেঞ্জের। এরই মধ্যে তাদের কোল জুড়ে আসে এক ফুটফুটে পুত্র সন্তান। টানাটানির সংসারে খুশীর বার্তার সাথে সাথে দুশ্চিন্তাও সমান তালে বাড়তে থাকে এই যুগলের। পরে সাহস করে একটা মুদি দোকান শুরু করেন নিজেদের শহরে। নাম দিলেন “তাগলক স্টোর”। পাহাড়ি মানুষের জন্য ব্যবসা হল অন্ধ মানুষের খাদের কিনারায় হাঁটার মত। ব্যবসায় অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রতিনিয়ত প্রতারণা আর ঠকবাজির শিকার হতে হয়। ফলে কিছু শুরু করতে না করতে শেষ হয়ে যায়। যাই হোক, সবকিছু মোকাবেলা করে একটু একটু করে বাড়তে থাকে এই স্টোরের পরিচিতি। এক পর্যায়ে সম্পূর্ন স্টোরের দায়িত্ব নিয়ে নেন পড়ালেখায় স্নাতক সুচরিতা। সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত একা একা সামলে নেন সম্পূর্ন ব্যবসা। একবার রাতের অন্ধকারে বাড়ি ফেরার সময় পা পিছলে পড়ে হাত ভেঙ্গে ফেলেন। সেই ভাঙা হাত নিয়েও দোকান চালিয়েছিলেন। এক দিনের জন্যও দোকান বন্ধ রাখেননি। স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে প্রায় ১০ বছর ধরে একা নারী হয়েও বিভিন্ন কোম্পানির পুরুষ পণ্য পরিবেশক এবং সরবরাহকারীদের সাথে নানা ঝুটঝামেলা সহ্য করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন নিজের ব্যবসা। অনেক সময় কাস্টমারের অযাচিত ব্যবহারেরও মুখোমুখি হয়েছেন। এরপরও একটুখানি দমে যাননি সুচরিতা। বরং নিজের অমায়িক এবং হাসিখুশি ব্যবহারের জন্য সম্পূর্ন রাঙ্গামাটিতে “ভুজি” (বৌদি) নামে এক নামে পরিচিতি পেয়েছেন। “ভুজি” নামের আড়ালে হারিয়ে ফেলেছেন নিজের কেতাবি নাম সুচরিতা। তেমনি ‘তাগলক স্টোর’ হয়ে গেছে ‘ভুজি দোকান’। তার দোকানের এক কাপ চা না হলে রাঙ্গামাটির অনেকের দিন চলেনা! তাই সারাদিন জমজমাট ভুজি দোকান।
একজন স্নাতক পাশ হয়েও মুদি দোকানী ব্যবসাকে নিজের পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কত শত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে তিনি অনেকটা নিজের একটা ব্রান্ড প্রতিষ্ঠা করেছেন। এরই মধ্যে তিনি বেশ কিছু কো-অপারেটিভ এর সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন। অনেক নারী-পুরুষকে নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে উৎসাহিত করছেন। পুঁজি বাড়ানোর জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করছেন। আবার সমান তালে সংসারও চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সফলভাবে। জীবন যুদ্ধে পোড় খাওয়া এই সাহসী নারী তার সংগ্রামী মানসিকতা দিয়ে আগামী দিনে আরও অনেকজনকে উৎসাহিত করবেন বলে আমার বিশ্বাস।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আমাদের ভুজির মত সকল প্রত্যয়ী সংগ্রামী মানসিকতার সাহসী নারীদের জানাই শ্রদ্ধা, সম্মান আর অভিবাদন।