দুই হুজুরের গল্প

দুই হুজুরের গল্প

দুই হুজুরের গল্প

দুই হুজুরের গল্প

দেশ বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান সরকার সৈয়দ মুজতবা আলীকে সাদরে বগুড়া কলেজের প্রিন্সিপাল করে নিয়ে যান। কিন্তু মুসলিম লীগের কাজকর্ম বিশেষ করে কলেজের কাজে তাদের মাতব্বরি, তাঁর একদম পছন্দ হচ্ছিল না। একবার কবি ইকবালের জন্ম–জয়ন্তীতে এই অশান্তি চরমে উঠল। কয়েকজন লীগ নেতা ইকবালকে বিশ্বকবি প্রতিপন্ন করতে উঠেপড়ে লাগলেন। চিরকালের স্পষ্টবক্তা মুজতবা সভার মধ্যেই বলে উঠলেন, ইকবাল বড় কবি সন্দেহ নেই, কিন্তু বিশ্বকবি তাঁকে বলা যায় না। বিশ্বকবি হওয়ার কতকগুলি বিশেষ লক্ষণ থাকে, যেমনটি আছে রবীন্দ্রনাথের মাঝে। তিনিই বিশ্বকবি।সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম লিগ নেতারা তৎপর হয়ে উঠল, শুরু করলো তাঁকে ভারতের চর বলা। অবস্থা এমন হল, তাঁর মেজদা যিনি তখন ওদেশে ডিভিশনাল কমিশনার– তিনিও ভয় পেয়ে গেলেন। বলে পাঠালেন ....."সীতু, তুই এখুনি ভারতে চলে যা। এখানে তোকে আমি বাঁচাতে পারব না, ডিভিশনাল কমিশনার হয়েও না।" সেই থেকে সীতু বা সৈয়দ মুজতবা আলী ভারতের বাসিন্দা, থাকতেন পার্ক সার্কাসে। যদিও তার স্ত্রী রাবেয়া ও দুই পুত্র পূর্ব পাকিস্তানেই থেকে গেলেন।একদিন পার্ক সার্কাসের বাড়িতে গেছেন মিত্র ও ঘোষ প্রকাশনার সবিতেন্দ্রনাথ রায়, যাকে উনি ভালোবেসে ভানুমিঞা বলে ডাকতেন। সেদিন ছিল এক প্রকাশকের পিতৃশ্রাদ্ধ, আলী সাহেবেরও বই ছেপেছেন সে প্রকাশক। কথা ছিল উনি তাকে ট্যাক্সিতে নিয়ে ঐ প্রকাশকের বাড়ি যাবেন। গিয়ে দেখেন বন্ধু–‌বান্ধব সমাবৃত হয়ে হুইস্কির আসর বসেছে। ভানুবাবু গিয়ে বললেন, এ কী আপনি এখনো তৈরি হননি ? আজ তো ব্রজবাবুর বাবার শ্রাদ্ধ !উনি লজ্জিত হয়ে বলে উঠলেন, এই ঝান্ডুগুলোর জন্য সকালবেলা বিপত্তি হয়ে গেল। এই ওঠো ওঠো সব।

 

ভানুবাবুকে বসতে বলে উনি তৈরি হতে গেলেন।মুখে চোখে জল দিয়ে ধুতি পাঞ্জাবি কোলাপুরি চটি পরে বেরোলেন। জল দিলে কি হবে, ফর্সা রঙে আঙুর রসের রক্তিমাভা এড়াবেন কী করে ?‌যাই হোক যখন গিয়ে পৌঁছলেন, তখনও শ্রাদ্ধকর্ম চলছে। এক পাশে দাঁড়িয়ে আলী সাহেব বিনীত ভাবে বললেন "দেখুন আমি মুসলমান, আপনারা যদি অনুমতি করেন তাহলে আমি একটু গীতাপাঠ করতে পারি।"প্রকাশক ভদ্রলোক তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, কী বলছেন আলীদা, আপনি আমার কাছে বড় ব্রাহ্মণ। আমি আসন আর গীতা আনছি।উনি বললেন, গীতা লাগবে না শুধু একটা আসন হলেই চলবে।আসন এল। আলী সাহেব আসন–‌পিঁড়ি হয়ে বসে গীতার একাদশ অধ্যায় পুরো আবৃত্তি করে গেলেন। শ্রাদ্ধ বাসরে তখন পিন পড়লেও শব্দ শোনা যেতো!##সেন বংশের তো অনেক বিখ্যাত মানুষের নাম শুনেছেন, গিরিশ চন্দ্র সেনের নাম শুনেছেন কি ?গুগল সার্চ করলে দেখবেন এনার পরিচিতি....ইসলাম ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআন- এর প্রথম বাংলা অনুবাদক এবং প্রকাশক !ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত এই মানুষটি ছিলেন আরবি ও ফারসি ভাষায় সুপন্ডিত। আচার্য কেশবচন্দ্রের অনুরোধে তিনি আরবি-ফার্সি সাহিত্যের ওপরআরো গভীর জ্ঞান অর্জন এবং পড়াশোনা করার জন্য কানপুর ও লখনউ তে যান। ফিরে আসার পর কেশবচন্দ্রের উৎসাহেই তিনি ইসলামি দর্শনের উপর গবেষণা শুরু করেন। কিন্তু ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে পড়াশোনা ও গবেষণা করার জন্য প্রধান বাধাই ছিল ভাষা। হিন্দু ও খ্রিস্ট ধর্মের ধর্মগ্রন্থ গুলো অনেক আগেই বাংলায় অনূদিত হয়েছিল, কিন্তু ইসলাম ধর্মের কোন ধর্মশাস্ত্রই বাংলাভাষায় ছিলনা। বিশেষ করে পবিত্র কুরআন ও হাদিস তখনো বাংলায় প্রকাশিত হয়নি।আর ঠিক এই কারণে কুরআনের মর্মার্থ অনুবাধন করা থেকে আপামর বাঙালী মুসলিম সমাজ ছিল পুরোপুরিই বঞ্চিত। ব্রাহ্মসমাজের কেশবচন্দ্র সেন পরিচালিত নববিধান সভা ইসলাম ধর্মগ্রন্থসমূহ বাংলায় অনুবাদ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। স্বাভাবিকভাবেই, আরবি-ফার্সি ভাষার সুপন্ডিত ভাই গিরিশচন্দ্র সেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এ দায়িত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করেন।সেসময় সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল যে, মূলভাষা থেকে অনূদিত হলে গ্রন্থটির পবিত্রতা ক্ষুণ্ন হবে। এই কারণে অনেক মুসলিম মনীষী এর বঙ্গানুবাদ করতে সাহস পাননি। গিরিশচন্দ্র সেন অন্য ধর্মাবলম্বী হয়েও এই ভয়কে প্রথম জয় করেন। শুধু কুরআন শরীফের প্রকাশনা নয় তিনি ইসলাম ধর্ম বিষয়ক আরও অনেক গ্রন্থ অনুবাদ করেন। ‌প্রকৃত অর্থে দুই জ্ঞানী পুরুষ কে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow